ইসলামে নারী: মর্যাদা, অধিকার ও ভূমিকা

মাওলানা শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে 

ইসলামে নারীকে যে মর্যাদা ও অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা বিশ্বের অন্য কোনো ধর্ম বা জীবনব্যবস্থায় বিরল। ইসলাম আবির্ভাবের আগে জাহেলিয়াতের যুগে নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখা হতো, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো এবং সমাজে তাদের কোনো অধিকার ছিল না। কিন্তু ইসলাম এসে সেই অন্ধকার দূর করে নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে নারীর মর্যাদা, অধিকার এবং সমাজে তার ভূমিকা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইসলামে নারীর মর্যাদা

ইসলামে নারীকে মায়ের ভূমিকায় সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জান্নাত মায়ের পায়ের নিচে।” এই একটি হাদিসই মায়ের মর্যাদা বোঝার জন্য যথেষ্ট। ইসলাম একজন নারীকে শুধু মা হিসেবেই নয়, বরং স্ত্রী, কন্যা ও বোন হিসেবেও সম্মান দিয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম।” এখানে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নারীরাই প্রধান। ইসলাম নারীর সম্মান রক্ষার্থে পর্দা প্রথা দিয়েছে, যা নারীকে সমাজের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে।

নারীর অর্থনৈতিক অধিকার

ইসলাম নারীকে অর্থনৈতিক অধিকার দিয়েছে, যা অনেক আধুনিক সমাজেও অনুপস্থিত। ইসলামে নারী তার উপার্জিত সম্পদের পূর্ণ মালিক। বিয়ের সময় প্রাপ্ত মোহরানা, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি এবং নিজের উপার্জিত অর্থ—সবকিছুতেই তার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এসব সম্পদ সে নিজের ইচ্ছামতো ব্যয় করতে পারে। এমনকি তার স্বামীরও সেই সম্পদে কোনো অধিকার নেই। ইসলামে বিয়ের পরও নারী তার পারিবারিক উপাধি পরিবর্তন করতে বাধ্য নয়, যা তার নিজস্ব পরিচিতি ও সত্তা বজায় রাখে।

নারীর শিক্ষাগত অধিকার

ইসলামে জ্ঞানার্জন নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ফরজ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ।” ইসলামে নারীকে জ্ঞান অর্জনে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি, বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে অনেক বিদুষী নারী ছিলেন, যারা হাদিস, ফিকাহ এবং অন্যান্য ইসলামিক বিজ্ঞানে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। আয়েশা (রা.) ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম, যিনি অসংখ্য হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং অনেক সাহাবিকে শিক্ষা দিয়েছেন।

নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার

ইসলাম নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে। যদিও ইসলামে নারীদের ঘরের দায়িত্ব পালনের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, তবে এর মানে এই নয় যে তারা সমাজের বাইরে থাকবে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে নারীরা বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করতেন। প্রয়োজনের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে আহতদের সেবা করতেন এবং প্রয়োজনে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতেন। নারীদের রাজনৈতিক মতামত গ্রহণের উদাহরণও পাওয়া যায়, যেমন: ইসলামের প্রথম যুগে খলিফা উমর (রা.) একজন নারীর সমালোচনার পর নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিলেন।

নারী ও পুরুষের সম্পর্ক

ইসলামে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সহযোগিতার উপর ভিত্তি করে গঠিত। ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে পোশাকের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যা একে অপরের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখে এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো একজন অন্যের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। বরং উভয়ই একে অপরের পরিপূরক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তারা তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরা তাদের জন্য পোশাক।”

ইসলামে নারীকে পুরুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়, বরং সহযোগী ও সহযাত্রী হিসেবে দেখা হয়েছে। নারীর মর্যাদা, অধিকার ও ভূমিকা নিয়ে ইসলাম যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা নারী ও পুরুষের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে সহায়ক। ইসলামে নারী শুধুই একজন স্ত্রী বা মা নয়, বরং সে একটি সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যার সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *