জুলাই হত্যাকাণ্ডের গোপন কল রেকর্ড, ফরেনসিকে ৩ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ফোন

ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলন দমনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে সাবেক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের বিষয়টি এখন তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে। অভিযোগ উঠেছে, তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা এবং দলের বিশ্বস্ত নেতাকর্মীদের আন্দোলন দমনে গুলি চালানোর নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

এই অভিযোগের সূত্র ধরে সাবেক ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা তানভীর হাসান সৈকতের ব্যবহৃত ফোনসেটগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।সরকার পতনের পর আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় এই তিন আসামি গ্রেফতার হন। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। পরে ফোনসেটগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষার অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। সে অনুযায়ী আসামিদের মোট সাতটি ফোনসেট সিআইডির ল্যাবে পাঠানো হয়।এর মধ্যে পলকের ব্যবহৃত তিনটি এবং টুকু ও সৈকতের দুটি করে চারটি ফোনসেট রয়েছে। তবে তদন্তসংশ্লিষ্টরা ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে রাজি হননি।প্রসঙ্গত, ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রযুক্তির সহায়তায় নানা ধরনের ডিজিটাল ডাটা পুনরুদ্ধার করা হয়ে থাকে। মোবাইল ফোনসহ যে কোনো ডিজিটাল ডিভাইস থেকে মুছে ফেলা ছবি, ভিডিও ও খুদে বার্তাসহ যাবতীয় ডকুমেন্ট ফিরে পাওয়া যায়। ২০২২ সালের এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল তথ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসাবে আদালতে গৃহীত হচ্ছে।মামলার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছর ২০ জুলাই পল্টন থানায় দায়েরকৃত রিকশাচালক কামাল মিয়া হত্যা মামলায় আসামিদের ব্যবহৃত উল্লিখিত সাতটি মোবাইল ফোনসেট জব্দ দেখানো হয়। পরে তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি ইন্সপেক্টর আব্দুল্লাহেল বাকী এগুলো ফরেনসিকে পাঠানোর আবেদন করেন।এতে বলা হয়, ‘আসামিরা সরকার এবং দলীয় পলিসি মেকার এবং ক্যাডার ছিলেন।

অত্র মামলায় তাদের সংশ্লিষ্টতা তথা হত্যাকাণ্ডের হুকুমদাতাসহ জড়িত অন্য আসামিদের শনাক্তকরণের জন্য এসব ফোনের ডিজিটাল ফরেনসিক পরীক্ষা করা প্রয়োজন।’জব্দ ফোনগুলোর মধ্যে রয়েছে সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের একটি আইফোন ফিফটিন প্রো এবং দুটি স্যামসাং এস টুয়েন্টিফোর আল্ট্রা, সাবেক ডেপুটি স্পিকার টুকুর ব্যবহৃত একটি নোকিয়া বাটন ফোন, একটি স্যামসাং গ্যালাক্সি এম ফোরটিন এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা সৈকতের একটি আইফোন ও একটি ডোকোমো ৫জি মডেলের ফোনসেট।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জুলাইজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠলে শেখ হাসিনা বিচলিত হয়ে পড়েন। এ সময় তৎকালীন মন্ত্রী-এমপি ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ফোন করে দফায় দফায় কথা বলেন তিনি। একপর্যায়ে সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে বিশেষ ব্লকরেইড অভিযান শুরু হয়। কিন্তু এতেও আন্দোলনের রাশ টানতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বিচারে গুলির নির্দেশ দেন ভারতে পলাতক সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

সূত্র জানায়, ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে শেখ হাসিনা সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের কাছে কয়েক দফা ফোন করেন।

প্রায় একই সময়ে তিনি তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তানভীর হাসান সৈকতের ফোনেও বিশেষ বার্তা পাঠান। হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যাল ও ভাইবারসহ বেশ কয়েকটি যোগাযোগ অ্যাপসে বার্তা আদান-প্রদান করা হয়।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তসংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, গ্রেফতারকৃত আসামিরা সরকার পতনের পরপরই আত্মগোপনে চলে যান। ওই সময় প্রত্যেকে তাদের ফোনসেট থেকে সব ধরনের ডাটা মুছে দেন। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল ও ভাইবার অ্যাপস ডিলিট করে দেওয়া হয়। এর ফলে জব্দকৃত ফোনসেটে কোনো ধরনের তথ্য পাওয়া যায়নি। পরে ফোনসেটগুলো ফরেনসিকের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়।

আদালত আবেদন মঞ্জুর করেন।পুলিশের আবেদনে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে (আসামিদের) তথ্য আদান-প্রদানের সম্পূর্ণ ইতিহাস, সময়কাল, বার্তার বিষয়বস্তু এবং মিডিয়া ফাইল (ছবি, ভিডিও এবং অডিও) আদান-প্রদান হয়েছিল কি না সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। এছাড়া মুছে ফেলা বা আর্কাইভড তথ্য, ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে কথোপকথন, খুদে বার্তা, গোপনীয় অ্যাপস, ই-মেইল আদান-প্রদান এবং এসব ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো পক্ষ যুক্ত থাকলে তার সম্পর্কেও তথ্য উদ্ধার করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির (গোয়েন্দা পুলিশ) ইন্সপেক্টর আব্দুল্লাহেল বাকী যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি গোপনীয়। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কয়েকটি ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষা চলছে। রিপোর্টে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত যথাসময়ে প্রতিবেদনে (চার্জশিট) উল্লেখ করা হবে।বিচার প্রক্রিয়ায় এ ধরনের ডিজিটাল তথ্যের গুরুত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গঠিত বিশেষ প্রসিকিউটরিয়াল টিমের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজি বলেন, জুলাই হত্যা মামলার তদন্তে ডিজিটাল ডিভাইসে রক্ষিত এসব তথ্য-উপাত্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি সেসব তথ্য মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, সেক্ষেত্রে তা বিচারের জন্য ম্যাটেরিয়াল ফ্যাক্টস হিসাবে গণ্য হবে।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *