মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যকার সম্পর্ক কি লাইনচ্যুত হয়েছে? রাশিয়ার একটি জনপ্রিয় সংবাদপত্র অবশ্য সেটাই মনে করছে। রুশ-মার্কিন সম্পর্কের বর্তমান ফুটিয়ে তোলার জন্য তারা রেলগাড়ির উদাহরণ টেনেছে। ‘মুখোমুখি সংঘর্ষ অনিবার্য বলে মনে হচ্ছে’, সম্প্রতি এ কথা বলেছেন রুশ ট্যাবলয়েড মস্কোভস্কি কমসোমোলেটস।
তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প লোকোমোটিভ এবং পুতিন লোকোমোটিভ একে অপরের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে এবং কোনো পক্ষই ইঞ্জিন বন্ধ করছে না বা থামাচ্ছে না এবং পেছনের দিকেও সরছে না। পুতিন লোকোমোটিভের পুরো মনোযোগ তাদের তথাকথিত ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের দিকে।
ক্রেমলিনের এই নেতা শত্রুতা শেষ করা কিংবা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার ক্ষেত্রে কোনো আগ্রহ দেখাননি।
অন্যদিকে, ‘ট্রাম্প লোকোমোটিভ’ ইতোমধ্যে ইউক্রেনে যুদ্ধ থামাতে সময় বেঁধে দেওয়া, রাশিয়ার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞার হুমকি, ভারত ও চীনের মতো বাণিজ্যিক অংশীদারদের ওপর বড় ধরনের শুল্কারোপসহ নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে মস্কোর ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা চালিয়েছে। সেইসঙ্গে দুটি মার্কিন পারমাণবিক সাবমেরিন রাশিয়ার কাছাকাছি এলাকায় পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
লোকোমোটিভ থেকে আলোচনা যখন পারমাণবিক সাবমেরিনের দিকে যাচ্ছে, তখন আপনাকে বুঝতে হবে, বিষয়টি গুরুতর। কিন্তু এটার অর্থ কী? ইউক্রেন ইস্যুতে হোয়াইট হাউস কি সত্যিই ক্রেমলিনের সঙ্গে ‘সংঘর্ষের পথে’ এগোচ্ছে? নাকি চলতি সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের মস্কো সফর এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে এখনও একটি চুক্তি হওয়া সম্ভব?
ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে উষ্ণ সূচনা
ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরের কয়েক সপ্তাহ মনে হয়েছিল, নিজেদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে মস্কো এবং ওয়াশিংটন। তখন ‘মুখোমুখি সংঘর্ষের’ কোনো ইঙ্গিত তো দূরের কথা, মাঝে মাঝে এমনও মনে হচ্ছিলো যেন ভ্লাদিমির পুতিন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প একই গাড়িতে, একই দিকে এগিয়ে চলেছেন।
গত ফেব্রুয়ারিতেও রাশিয়ার পক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনে রুশ ‘আগ্রাসনের’ নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘে ইউরোপের নেতৃত্বে যে প্রস্তাব তোলা হয়েছিল, সেটির বিরোধিতা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওই মাসে এক টেলিফোন আলাপে দু’দেশের প্রেসিডেন্ট একে অপরের দেশে রাষ্ট্রীয় সফরের কথাও বলেছিলেন। তখন মনে হচ্ছিল যে পুতিন-ট্রাম্প শীর্ষ সম্মেলন যেকোনো দিন হতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন সেসময় মস্কোর বদলে কিয়েভের ওপর চাপ প্রয়োগ করছিল। এছাড়া কানাডা এবং ডেনমার্কের মতো পুরোনো মিত্রদের সঙ্গেও লড়াইয়ের পথে এগোতে দেখা যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। মার্কিন কর্মকর্তারা নিজেদের বক্তৃতা এবং সাক্ষাৎকারে ন্যাটো এবং ইউরোপের নেতাদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।সেগুলো তখন ক্রেমলিনের কানে সুর হয়ে বাজছিল।
‘ব্রাসেলস বা কিয়েভের তুলনায় আমেরিকার এখন রাশিয়ার সঙ্গে অনেক বিষয়ে বেশি মিল রয়েছে, গত মার্চে রুশ গণমাধ্যম ইজভেস্তিয়াকে বলেন রাশিয়ার একাডেমি অব সায়েন্সেস সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কনস্টান্টিন ব্লোখিন।
পরের মাসে ওই একই সংবাদপত্রে বলা হয়- ‘ট্রাম্প সমর্থকরা বিপ্লবী। তারা প্রচলিত ব্যবস্থা ভেঙে ফেলছেন। তাদের এই কাজে সমর্থন দেওয়া যেতে পারে। পশ্চিমাদের ঐক্য আর নেই। ভূ-রাজনৈতিকভাবে তারা আর জোটবদ্ধ নয়। ট্রাম্পের সমর্থকরা ট্রান্সআটলান্টিক ঐক্যমত্যকে আত্মবিশ্বাস এবং দ্রুততার সঙ্গে ভেঙে দিয়েছে।’ ততদিনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ রাশিয়ায় নিয়মিতভাবে সফর করতে শুরু করেছেন। মাত্র দুই মাসের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে তিনি দেশটিতে অন্তত চারবার সফরে আসেন। সেখানে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেন। এর মধ্যে একটি বৈঠকের পর ক্রেমলিনের নেতা হোয়াইট হাউসে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি প্রতিকৃতিও উপহার দেন। এ ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রীতিমত ‘মুগ্ধ হয়েছিলেন’ বলে জানা যাচ্ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মস্কোর কাছ থেকে নিজের প্রতিকৃতির চেয়েও বেশি কিছু চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে প্রেসিডেন্ট পুতিন যেন একটি নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর করেন।
ট্রাম্পের ক্রমবর্ধমান হতাশা
ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে রাশিয়ার উদ্যোগ এখন নিশ্চিত। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধ বন্ধ করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। যদিও তিনি দাবি করেছেন, বিষয়টি নিয়ে একটি কূটনৈতিক সমাধানের মস্কো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু নানাভাবে চেষ্টার পরও ইউক্রেনে যুদ্ধ না থামায় ক্রেমলিনের প্রতি ক্রমশই হতাশ হয়ে পড়েন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সম্প্রতি তিনি ইউক্রেনে বিভিন্ন শহরে রাশিয়ার একের পর এক আক্রমণকে ‘ঘৃণ্য’ এবং ‘লজ্জাজনক’ বলে নিন্দা করেছেন। সেইসঙ্গে প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে ইউক্রেন সম্পর্কে ‘অনেক বাজে মন্তব্য করার’ অভিযোগ তুলেছেন।
যুদ্ধ বন্ধে গত মাসে পুতিনকে ৫০ দিনের সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেইসঙ্গে দেওয়া হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা এবং বাড়তি শুল্ক আরোপের হুমকি। পরবর্তীতে ট্রাম্প সেই সময়সীমা আরও কমিয়ে দশ দিনে নিয়ে আসেন। চলতি সপ্তাহে সেই আল্টিমেটামের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু ওয়াশিংটনের চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন– এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন বাস্তবে কতটুকু চাপের মধ্যে রয়েছেন?
‘যেহেতু ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক বার (যুদ্ধ বন্ধের) সময়সীমা পরিবর্তন করেছেন, কাজেই আমার মনে হয় না পুতিন তার কথা এতটা গুরুত্ব সহকারে নেন, বলছিলেন নিউইয়র্কের বিশ্ববিদ্যালয় দ্য নিউ স্কুলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক শিক্ষক নিনা ক্রুশ্চেভা।
তিনি বলেন, পুতিন যতদিন সম্ভব লড়াই করবেন, যদি না এর মধ্যে ইউক্রেন বলে- আমরা ক্লান্ত, আমরা তোমাদের শর্ত মেনে নিতে রাজি।
‘আমি মনে করি, পুতিন ক্রেমলিনে বসে ভাবছেন, তিনি রুশ জার এবং জোসেফ স্ট্যালিনের স্বপ্ন পূরণ করছেন। পশ্চিমাদের বোঝাচ্ছেন যে, রাশিয়ার সঙ্গে অসম্মানজনক আচরণ করা উচিত নয়।’
এখনও চুক্তি সম্ভব
নিনা ক্রুশ্চেভা বলেন, আমি এখন পর্যন্ত যে যে বিষয় বর্ণনা করেছি, তাতে মনে হতে পারে যে, পুতিন এবং ট্রাম্পের লোকোমোটিভের মধ্যে ‘মুখোমুখি সংঘর্ষ’ অনিবার্য। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটনার সম্ভাবনা কম।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে একজন ‘দুর্দান্ত চুক্তিকারী’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, তিনি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একটি চুক্তি করার বিষয়ে হাল ছেড়ে দেননি।
চলতি সপ্তাহে ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ ক্রেমলিনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে আবারও রাশিয়ায় আসছেন। আমরা এখনেও জানি না, তিনি ঠিক কী ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আসবেন। তবে মস্কোভিত্তিক কিছু বিশ্লেষক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, স্টিভ উইটকফের এই সফরে রাশিয়া লাভবান হবে।
রাশিয়া ‘নিষেধাজ্ঞা এড়াতে বেশ ভালো বলে মনে হচ্ছে’ গত রোববার এমন মন্তব্য করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
সোমবার মস্কোর এমজিআইএমও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইভান লোশকারেভ রুশ গণমাধ্যম ইজভেস্তিয়াকে বলেছেন, সংলাপকে তুলনামূলক সহজতর করার জন্য উইটকফ (রাশিয়ার কাছে) এমন ধরনের সহযোগিতা প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারেন, যা ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চুক্তি স্বাক্ষরের পরে বাস্তবায়িত হবে। সাড়ে তিন বছর ধরে যুদ্ধ চালানোর পর এ ধরনের প্রস্তাবনা মেনে ক্রেমলিন কি শান্তি স্থাপনে রাজি হবে? কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সর্বোপরি ইউক্রেনের ভূখণ্ডের দখল, ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা এবং তাদের ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনীর আকারের বিষয়গুলো নিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন এখন পর্যন্ত তার অবস্থান থেকে সরে আসেননি। ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি চুক্তি চান। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন চান বিজয়।