৬ আগস্টের আগে কখনও মাহফুজ ভাইকে দেখিনি, চিনিও নাই, কথাও হয়নি: রাফি

গণমঞ্চ ডেস্ক –

ঢাকায় এসে ৬ আগস্ট বঙ্গভবনে যাওয়ার দিনই প্রথম দেখা হয় মাহফুজ ভাইয়ের সঙ্গে, সেদিনই প্রথম পরিচয়, এর আগে কখনও মাহফুজ ভাইকে দেখিনি, চিনিও নাই, কথাও হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের অন্যতম সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি।

আজ বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক পোস্টে এমন মন্তব্য করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম এ সমন্বয়ক।

গণমঞ্চের পাঠকদের জন্য রাফির ফেসুবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো। ফেসবুক পোস্টে রাফি বলেন, ‘চট্টগ্রামের আন্দোলনটা প্রথমেই শুরু হয় ছোট্ট পরিসরে। চবিতে যারা ছিলেন তারা জানেন এই জায়গায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াটা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিলো। ৩রা জুলাই যখন আমরা ১ নাম্বার গেট (চট্টগ্রাম – রাঙ্গামাটি,খাগড়াছড়ি) অবরোধ করি সেদিন আমাকে ছাত্র*লীগ প্রথমে কলা ঝুপড়িতে নিয়ে যায়। তারপর আলাওল হলের ৪ তলায় একটা রুমে প্রায় ৬ ঘন্টা আটকে রেখে আমার ফোন তল্লাশি করে এবং বিভিন্নভাবে ফ্যা’সিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলের ট্যাগ দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেরকম কিছুই পায়নি। চট্টগ্রামের আন্দোলনের ব্যাপারে সারাদেশের মানুষই জানে, আন্দোলন নিয়ে আস্তে ধীরে সবকিছু লিখবো।

কিছু বিষয় বলা জরুরি-

১. চট্টগ্রামসহ সারা দেশের আন্দোলনে শি’বির, দল, বাম-ডান, পাবলিক, প্রাইভেট, জাতীয়, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ সবাই ছিলো। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে কারো সাথেই আমার পরিচয় ছিলো না। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে পরিচয় হয়। আমাদের একটা QMT টেলিগ্রাম গ্রুপ ছিলো, সেখানে ৪০/৫০ জন সদস্য ছিলো। আমাদের প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত সেই গ্রুপের সকল সদস্যদের সাথে গুগল মিটে আলোচনা করে নেওয়া হতো। তবে সেই গ্রুপের অনেকেই সমন্বয়ক লিস্টে ছিলেন না। ৩০ জুলাইয়ের দিকে আন্দোলনকে গতিশীল করার জন্য প্রত্যেক জেলা ভিত্তিক সমন্বয়ক লিস্ট করা হচ্ছিলো। আমি,রাসেল ভাই আমরা সবাই মিলে চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে একটা লিস্ট পাঠাই ফোন নম্বরসহ। পরবর্তীতে লিস্ট পাবলিক হওয়ার সাথে সাথেই অনেকের বাসায় ছাত্র*লীগ হামলা চালায়। অনেকেই তখন নাম কাটার জন্য আমাদেরকে প্রেশার ক্রিয়েট করে। তখন আমরা কেন্দ্রের সাথে কথা বলে নতুন করে নাম পাঠাই এবং আগের টা বাতিল করা হয়। আর এই লিস্টের ব্যাপারটা রাসেল ভাই সমন্বয় করেছিলো। তবে আন্দোলনের পর সেই গ্রুপের যারা সমন্বয়ক ছিলো না তারা আবার আমাদেরকে বললো যেন সমন্বয়ক কমিটিতে নাম লিস্টেড করা হয়।

২. ১৬ জুলাই কর্মসূচী শেষ হওয়ার পর যখন স্পট ত্যাগ করবো তখন আমাকে আর রাসেল ভাইকে আমাদের সহযোদ্ধারা একটা সিএনজিতে উঠিয়ে দিয়ে নিরাপদে স্পট ত্যাগ করতে সহযোগিতা করে। সেখানে ছাত্রদলের কয়েকজনের সাথে আমার পরিচয় হয়। উঠার পর কিছুদূর গিয়ে রাসেল ভাই শি’বিরের অংশগ্রহণের ব্যপারে আমাকে জানায়। আন্দোলনে সাধারণ মানুষ, দল, শিবির, বাম, ডান অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সমান অংশগ্রহণ ছিলো। এখানে এককভাবে কারো কোনো ক্রেডিট নেবার সুযোগ নেই। তবে আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে সমন্বয়কগণ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং লিস্টেড সমন্বয়কদের ঝুঁকি প্রতিদিন, প্রতিরাতেই হুমকির শিকার হয়েছে, কেউ বাসায় থাকতে পারেনি।

৩. ১৫ জুলাইয়ের পর থেকেই ঢাকার সাথে আমাদের সমন্বয়টা কমে যায়। নানান জটিলতার কারণে যোগাযোগ কমে যায়। তবে ১৫ জুলাই থেকে আমি আর রাসেল ভাই একই সাথে, একই বাসায় ছিলাম। যার ফলে আমাদের চট্টগ্রামে আন্দোলন চালিয়ে নিতে অনেক সুবিধা হয়েছিলো। প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত আমরা সামনাসামনি আলাপ আলোচনা করে নিতে পারতাম। ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে ঢাকার সাথে টোটালি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। মাঝেমধ্যে ঢাবির মাহিন সরকার ভাই এবং ঢাকা কলেজের রাকিব ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ হতো। আর মহিউদ্দিন রনি ভাইয়ের সাথে আমার কন্টিনিউ যোগাযোগ ছিলো। প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত রনি ভাইয়ের সাথে আলোচনা করেই নিতাম। প্রায় প্রতিদিনই ২/৩ মিনিট ফোনে কথা বলতাম। যেহেতু ঢাকার কারো সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো না, কি করবো না করবো সে ব্যাপারে কোনো ম্যাসেজও পেতাম না, যতটুকু পেতাম সেটা অনলাইনে সেক্ষেত্রে তখন আমার একমাত্র ভরসার জায়গা ছিলো রনি ভাই। আর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী,রাঙ্গামাটি,খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এই জায়গাগুলোর সাথে আমারা চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি সমন্বয় করেছি।

৪. ইন্টারনেট আসার পর যখন ৬ সমন্বয়ক’কে ডিবিতে নিয়ে অ’স্ত্রের মুখে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয় তখন চট্টগ্রাম থেকে সাথে সাথেই তাদের প্র’ত্যাহারের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখান করে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবার বার্তা দিই। ঢাকা থেকে কে কি বলবে সেই অপেক্ষায় আমরা ছিলাম না। অথচ এখন হাইলাইট করা হয়, ঢাকার ২/৩ টা ফেইসকে যে তারাই তখন দাঁড়িয়েছিলো, তাঁরাই আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো! অথচ ২৮ জুলাইয়ের পর থেকে বীর চট্টলার রাজপথে মানুষের ঢল নামে। তাছাড়াও চট্টগ্রামের রাসেল ভাইসহ ডিবি হেফাজতের বাহিরে থাকা প্রত্যেক সমন্বয়ক তখন আন্দোলন চালিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৫. ৫ আগস্টের আগে আমরা অনেকেই কোনো মাস্টারমাইন্ডকেও চিনতাম না, কোনো ইমামকেও চিনতাম না। এতে অনেকের মন খারাপ হতে পারে কিন্তু এটাই সত্য। ৫ আগস্ট সন্ধ্যার পর যখন চ্যানেল ২৪ এ সবাইকে ডাকা হয় তখন আমি ঢাকায়ই ছিলাম, ইভেন সেদিন সকাল ৬ টায় আমি মার্চ টু ঢাকায় যোগ দিতে টিএসসিতে পৌঁছাই। তবে চ্যানেল ২৪ এ সামনে সারির সমন্বয়কদের দাওয়াত দেওয়া হয় কিন্তু আমাকে কেউ জানায়নি, কোনো একভাবে আমি সেটা জানতে পেরে সেখানে গিয়ে সবার সাথে দেখা হয়। তখন অলরেডি পোগ্রাম শুরু হয়ে যায়। তারপর দুইটা সংবাদ সম্মেলন হয়, প্রথম টা আমি, হান্নান মাসুদ ভাই, মাহিন ভাই সহ আমরা করি। দ্বিতীয় টা সবাই মিলে করা হয়। তবে সেখানে সামনের সারিতে ছিলো এমন অনেকেই যাদেরকে আপনারা চিনতেন না। সেখানে সামনে সারিতে জায়গা করে নেওয়াটা ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য, যার ফলে ওরকম কোনো কষ্ট না করে পেছনের সারিতে চুপচাপ বসে গেলাম। ঢাবি কেন্দ্রীক সমন্বয়করা সেখানে অগ্রাধিকারী ছিলো। প্রথমটায় সবাই ছিলো না কেন জানি না, ধারণা করেছিলাম কিছু একটা ক্যাচাল হয়েছে।

৬. ৬ আগস্ট হঠাৎ রিফাত রশিদ ভাই আমাকে কল দিয়ে বলে তুই একা কার্জন হলের সামনে আয়। বলে রাখা প্রয়োজন, কি জন্য কার্জন হলের সামনে ডেকেছে সে ব্যাপারে আমি জানতাম না। পরবর্তীতে জানলাম যে বঙ্গভবনে যেতে হবে, তবে কি জন্য যেতে হবে সেটা জানতে পারলাম না। খুব সম্ভবত টোটাল ৮/৯ জন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি সিলেক্ট করা হয় বঙ্গভবনে যাবার জন্য। তারমধ্যে ডিবিতে থাকা ৬ জন, আমি, প্রাইভেটের ১ জন মেয়ে ১ জন ছেলে, আমি তাদের নামগুলো ভুলে গিয়েছি। তারপর সেখানে গিয়ে মাহফুজ ভাইয়ের সাথে পরিচয় হলো, আসিফ নজরুল স্যার এবং তানজিম স্যারের সাথে দেখা হলো। এর আগে আমি কখনো মাহফুজ ভাইকে দেখিনি, চিনিও না এবং কখনো কথাও হয়নি। রাষ্ট্রপতির সাথে কথা বলার জন্য ২/৩ জন প্রতিনিধি ভেতরে যায় এবং আমরা বাহিরে আরেকটা কনফারেন্স রুমে বসে ছিলাম। তারপর মিটিং শেষ করে আমরা টিএসসিতে আসলাম এবং যে যার মতো চলে গেলাম। আর সেদিনই প্রথম উপদেষ্টা শারমিন মুর্শিদ ম্যামকে সবার সাথে পরিচয় হতে দেখলাম।

৫ আগস্টের পর প্লাস মাইনাস আরও অনেক কিছুই হয়েছে, ধীর ধীরে সব লেখা হবে। ধন্যবাদ।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *