অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরস্টার কলেজের শিক্ষার্থী ফারাহ্ দিবা খানছবি: ফারাহ্ দিবা খানের সৌজন্যে
বিশ্বের নানা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনোটা শত বছরের পুরোনো, কোনোটায় শিক্ষক হিসেবে আছেন একাধিক নোবেলজয়ী অধ্যাপক। স্বনামধন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা কেমন? পড়ুন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরস্টার কলেজের শিক্ষার্থী ফারাহ্ দিবা খান–এর লেখা
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় বুঝে গিয়েছিলাম, শুধু চিকিৎসক হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না আমার স্বপ্ন। সেই চাওয়া থেকেই পরিশ্রম, প্রস্তুতি আর সাহস নিয়ে আবেদন করেছিলাম অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এমএসসি বাই রিসার্চ ইন সার্জিক্যাল সায়েন্সেস’ প্রোগ্রামে। আবেদন মঞ্জুরও হয়েছিল। দুই বছরের মাস্টার্স কোর্স।মধ্যরাতে একা চড়ে বসেছিলাম বিমানে। প্রথম ইউরোপ সফর। প্রথম দিনটার কথা ভাবলে এখনো আনন্দে চোখে পানি চলে আসে। ক্যাম্পাসে পা রাখার পর ম্যাট্রিকুলেশন ডের দিন আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পাই। সেদিন সবাই ‘সাব ফাস্ক’ পরেছিল। এটা একধরনের ঐতিহ্য। এই দিনে অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থীদের কালো কোট, সাদা শার্ট আর গলায় কালো রিবন পরতে হয়। নানা দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যখন শত বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক শেলডোনিয়ান থিয়েটারের দিকে যাচ্ছিলাম, রাস্তার দু’পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে আমাদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এ যেন কোনো রাজকীয় যাত্রা।সেদিন অক্সফোর্ডের র্যাডক্লিফ ক্যামেরা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম। পঞ্চম শ্রেণিতে যেই ছবিটা মনে মনে কল্পনা করতাম, সেই ছবিটাই যেন এত বছর পর তোলার সুযোগ হলো! আমি ছিলাম অক্সফোর্ডের ওরস্টার কলেজে। এখানে আসার পরে একটা অন্য রকম আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে। অক্সফোর্ডে জন র্যাডক্লিফ হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল ক্লাসের প্রথম দিনটায় মন বলছিল, ‘ফারাহ্, তোমার তো এখানেই থাকার কথা ছিল।’
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ার অভিজ্ঞতা কেমন?
অক্সফোর্ডে আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে এখানকার শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার সংস্কৃতি। উত্তর মুখস্থ করার বদলে প্রশ্ন করাকে এখানে উৎসাহ দেওয়া হয়। শতাব্দী-পুরোনো রীতিনীতিও আমাকে শিখতে হয়েছে। গাউন পরে ডিনারে অংশগ্রহণ, নানা বিষয়ের অধ্যাপক ও গবেষকদের সঙ্গে হাই টেবিলে আলোচনায় অনেক কিছু শিখেছি। প্রাচীন ক্যাম্পাসের আঙিনা আর প্রাচীরের ভেতরেই এখানে চলে নতুন চিন্তার চর্চা। ক্যাম্পাসে আমার প্রিয় জায়গার মধ্যে অন্যতম বইয়ের গন্ধমাখা বোডলিয়ান লাইব্রেরি, র্যাডক্লিফ ক্যামেরা, আর আমার কলেজের লেকের পাশের বেঞ্চ। ক্লান্ত হয়ে যখন সেখানে বসি, চারপাশের নীরবতাই আমার ভেতরটাকে সরব করে তোলে।অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন চিকিৎসা–সংক্রান্ত উদ্ভাবন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও গবেষণাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আমার কাজও এসব নিয়ে। বিশ্বের যেসব প্রান্তে স্বাস্থ্যসেবা এখনো সীমিত, সেসব দেশের মানুষের জন্য কাজ করছি। আমার অনেকগুলো কাজের একটি হলো স্কোরিং টুলস। এই টুল শিশুর হৃদ্রোগ অপারেশনের পর জটিলতা আগেভাগে চিহ্নিত করতে পারে। দিতে পারে শিশুর শারীরিক অবস্থার পূর্বাভাস। ২০২৪ সালে এখানে আমার কাজের জন্য মিরান্ডা ব্রাউন ডাইভারসিটি লিডারশিপ বৃত্তি পেয়েছি। এ বছর যুক্তরাজ্যের আউটস্ট্যান্ডিং উইমেন ইন সায়েন্স সম্মাননা পেয়েছি ব্রিটিশ রাজকুমারী অ্যানের কাছ থেকে।
বাংলাদেশের শিশু-কিশোর আর তরুণদের মধ্যে প্রতিভার অভাব নেই। আমরা নানা সীমাবদ্ধতার কারণে আসলে আটকে থাকি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো মুখস্থনির্ভর, যেখানে প্রশ্ন করাকে একধরনের অপরাধ ভাবা হয়। অক্সফোর্ড ক্যাম্পাসে প্রশ্ন করা, চ্যালেঞ্জ করা স্বাভাবিক বিষয়। এই চর্চা আছে।ছোটদের বলব, তোমার স্বপ্নকে ছোট করে দেখো না। কোথায় জন্মেছ, কোথায় পড়েছ, সেসব শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নয়। কোথায় যেতে চাও, সেটাই আসল। সময় লাগবে, অনেক রাত জেগে কাজ করতে হবে, অনেক ‘না’ শুনতে হবে। কিন্তু সাহস রাখতে হবে; আর সবচেয়ে বড় কথা নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সাহসী। আমার গল্পটা শুধু আমার নয়, এটা সেইসব শিক্ষার্থীর গল্প, যারা এখনো রাত জেগে স্বপ্ন দেখে। চলো, আমরা একসঙ্গে ইতিহাস লিখি।