গাজায় তীব্র খাদ্য সংকটে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ফিলিস্তিনিরা

গাজার বাস্তুচ্যুত মানুষদের প্রতিটি দিন কাটছে চরম উৎকণ্ঠা, ক্লান্তি ও ক্ষুধার সঙ্গে। ইসরায়েলি বিমান হামলা, ঘুমহীনতা ও খাদ্য খোঁজার অস্থিরতা তাদের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে।

“দিনজুড়ে শুধু একটা চিন্তা—পরিবারের জন্য খাবার কোথায় পাব,” বলেন গাজা সিটির বাসিন্দা, বাস্তুচ্যুত পিতার রায়েদ আল-আথামনা, যিনি বিদেশি সাংবাদিকদের নিষেধাজ্ঞার কারণে ফোনে DW-কে সাক্ষাৎকার দেন।
“খাওয়ার কিছু নেই। এমনকি রুটি নেই, কারণ আমি ময়দা কিনতেও পারছি না—এটা খুব ব্যয়বহুল। আজ বাচ্চাদের জন্য সামান্য ডাল ছিল, কিন্তু আগামীকাল কী খাওয়াব, জানি না।”

আল-আথামনা, যিনি আগে গাজায় বিদেশি সাংবাদিকদের চালকের কাজ করতেন, বলেন, “এখন ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ইসরায়েলি বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ থেমে নেই। লোকজন ক্ষুধায় রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে—এমন ভিডিওতে সামাজিক মাধ্যম ভরে গেছে।”

মে মাসে DW-এর সঙ্গে সর্বশেষ কথা বলার সময় তিনি বলেছিলেন, পরিস্থিতি এর চেয়ে খারাপ হতে পারে না। কিন্তু দুই মাস পর তিনি বললেন, “এখন আরও খারাপ। একটা রুটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার নাতি-নাতনিরা কাঁদছে, বলছে: ‘আমরা রুটি চাই।’ কিছু দিতে না পারলে ওরা বুঝে না। এটা মন ভেঙে দেয়।”

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সতর্কবার্তা

জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা OCHA জানিয়েছে, গাজার প্রায় ৮৮% এলাকা এখন সামরিক অঞ্চল বা উচ্ছেদ আদেশের আওতায়। এসব এলাকায় গাজার কৃষিজমির বড় অংশও পড়েছে, ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষজন সীমিত জায়গায় গাদাগাদি অবস্থায় জীবন যাপন করছে এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আদহানম বলেন, “গাজার বিশাল জনগোষ্ঠী অনাহারে ভুগছে। আমি এটিকে ‘মানবসৃষ্ট গণ-অনাহার’ ছাড়া আর কী বলব?”

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার জরুরি পরিচালক রস স্মিথ জানান, “গাজায় ক্ষুধার সংকট এখন আশ্চর্যজনক স্তরে পৌঁছেছে। এক-তৃতীয়াংশ মানুষ একাধিক দিন না খেয়ে থাকছে, যার মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছে।”

গাজার হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৫ সালের জুলাই মাসেই ৪৮ জন মানুষ পুষ্টিহীনতায় মারা গেছে। বছরের শুরু থেকে এই সংখ্যা ৫৯ জন। ২০২৪ সালে ৫০ জন ও ২০২৩ সালে ছিল মাত্র চারজন। তবে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এ দাবিকে ‘প্রচারণা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে।


খাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে

তিন সন্তানের জনক আয়াদ আমিন বলেন, “খাবার পাওয়া যায় না, আর পেলেও দাম এত বেশি যে কেনা সম্ভব নয়।”
আজ তিনি দুটো আলু, দুটো টমেটো আর কয়েকটা ক্যাপসিকাম কিনেছেন ১৪০ শেকেল দিয়ে (প্রায় ৩৬ ইউরো/৪২ ডলার)। “এই সাধারণ জিনিসগুলো কিনতেও এত টাকা লেগেছে।”

শেরিন কামার, উত্তর গাজা সিটির এক মা বলেন, “আমরা আসলে খাদ্য ছাড়াই বেঁচে আছি। যা খাই তা কেবল বেঁচে থাকার জন্য। আমি গত চার মাসে ১৫ কেজি ওজন হারিয়েছি।”

তিনি আরও বলেন, “শিশুরা অসুস্থ হলে ওষুধ পাওয়া যায় না। হাসপাতাল আর আন্তর্জাতিক সংস্থার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় শুধু পেইনকিলারের জন্য।”


সীমিত সাহায্য, বাড়ছে মৃত্যু ও লুটপাট

মার্চে ইসরায়েল গাজার সীমান্ত বন্ধ করে দেয়, হামাসের কাছে সাহায্য চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখিয়ে। মে মাসে আংশিকভাবে তা খুলে দেওয়া হয়। এখন প্রতিদিন গড়ে ২৮টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক NGO MedGlobal জানায়, “জুলাইয়ের শুরু থেকে অপুষ্ট শিশুদের সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে।”

“মানুষের আর কোনো শারীরিক সঞ্চয় নেই,” বলেন সংগঠনটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও শিশু চিকিৎসক জন কাহলার। “একটি ভাইরাস এলেই ডায়রিয়ায় মৃত্যু হতে পারে, কারণ শরীর প্রতিরোধ করতে পারছে না।”


সহায়তার লাইনে গুলি, নিরাপত্তাহীনতা

ইসরায়েলি সামরিক সংস্থা কোগাত জানায়, “৯৫০টি ত্রাণ ট্রাক গাজার পাশে অপেক্ষা করছে,” তবে তারা দাবি করে ইসরায়েল ত্রাণে বাধা দেয় না। তবে জাতিসংঘ জানায়, ট্রাক চলাচলের জন্য ইসরায়েলের সামরিক অনুমতির অভাবই বড় প্রতিবন্ধকতা।

রবিবার, WFP-এর একটি কাফেলায় গুলি ছোড়ার ঘটনায় অনেকে আহত হন। গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত ৮৭৫ জন মানুষ ইসরায়েলি গুলিতে নিহত হয়েছেন খাদ্য সংগ্রহ বা অপেক্ষা করার সময়।

আল-আথামনা বলেন, “একবারই সাহায্য নিতে গিয়েছিলাম। আর যাই না। যদি গুলি খাও বা আহত হও, কেউ সাহায্য করে না। হাসপাতালেও কিছু নেই।”

তিনি বলেন, “তুমি হয় বোমায় মরবে, না হয় ক্ষুধায়। সবাই যুদ্ধবিরতি নিয়ে কথা বলছে, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না—বরং আরও খারাপ হচ্ছে। আমরা এখন কী করব?”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *