বিএনপি’র পুনর্গঠন রোডম্যাপ, নতুনত্ব ও রূপান্তর কৌশল;

জুলাই গণঅভ্যূত্থান নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন,  নতুন রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্ম ও  প্রকৃত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম তৈরি করেছিল। যা শুধুমাত্র ক্ষমতার পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ছিলনা, বরং একটি সুস্থ, জবাবদিহিমূলক জনবান্ধব রাষ্ট্র গঠন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ তীব্র কামনাকেই প্রতিফলিত করেছে। এই ক্রান্তিকালে, বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর সামনে শুধু জনপ্রিয়তা ফিরে পাওয়াই প্রশ্নই নয়, বরং তার অস্তিত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা রক্ষার প্রশ্ন জড়িত। অতীতের ভুল পথে ফিরে গেলে, পুরনো অভ্যাসে আটকে গেলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা অসম্ভব। তাই এখানেই প্রয়োজন “ব্যতিক্রম” হওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত – একটি মৌলিক, দৃশ্যমান ও গ্রহণযোগ্য রূপান্তরের, যা এই দলটিকে ‘অন্য সব দলের মতো’ নয়, বরং ‘সব দলের থেকে আলাদা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। এজন্য কিছু কৌশলগত ধারণা এই ব্যতিক্রমী যাত্রার সঠিক রূপরেখা তৈরি করতে পারে:

১.

পুরনো রাজনীতির কবর রচনা ও যুব নেতৃত্বে উদ্ভাবনী ধারার সূচনা করা সময়ের দাবী। বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও কার্যকলাপকে “পতিত স্বৈরাচারী সরকারের” ধারার অনুরূপ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যে কারণে সাধারণ জনগণ ও সচেতন নাগরিকের কাছে দলটির গ্রহণযোগ্যতাও হারাচ্ছে। এই বিষমুক্তির একমাত্র উপায় হলো বিদ্যমান গতানুগতিক পথের আমূল পরিত্যাগ।

যুব শক্তির প্রকৃত ক্ষমতায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্র কাঠামোয় সার্বিক শক্তির সঞ্চার করা। শুধু তরুণদের মুখপাত্র হিসেব নয়, দলের নীতিনির্ধারণী সর্বোচ্চ স্তরে (যেমন স্থায়ী কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি) উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যোগ্য ও জনপ্রিয় যুব নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্তি এখন অপরিহার্য। তাদের হাত ধরে আনতে হবে অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে সরাসরি জনসংযোগ, স্থানীয় সমস্যা ভিত্তিক এজেন্ডা প্রণয়ন এবং সম্পূর্ণ স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থাপনার মতো উদ্ভাবনী ধারণা।

দলীয় নীতিমালার বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। দলীয় কাঠামোর মধ্যে একটি স্বাধীন ‘নীতি ল্যাব’ বা গবেষণা ইউনিট গঠন করা দরকার, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী তরুণ গবেষক, অর্থনীতিবিদ, পরিবেশ বিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা সমকালীন চ্যালেঞ্জ (যুব বেকারত্ব, ডিজিটাল বৈষম্য, জলবায়ু অভিযোজন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সংস্কার) মোকাবেলায় প্রগতিশীল ও বাস্তবসম্মত নীতি প্রস্তাবনা তৈরি করবে। এই কেন্দ্র হবে দলের জন্য প্রকৃত সৎচিন্তার প্রাণভোমরা।

২.

জুলাইয়ের শক্তির সাথে অটুট বন্ধনের জন্য দৃঢ়তা হবে ঐক্য ও রাজনৈতিক পরিপক্কতার নিদর্শন। কারণ,

জুলাই গণঅভ্যূত্থান একটি একক দলের নয়, বরং গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষায় ঐক্যবদ্ধ নানা শক্তি ও জনগনের আকাঙ্ক্ষার ফসল। বিএনপির জন্য এই শক্তিগুলোর সাথে সম্পর্ক শুধু বজায় রাখাই নয়, গভীর ও সুসংহত করাও জরুরি।

গণতান্ত্রিক সংলাপের প্লাটফর্ম তৈরি করে ছাত্র সংগঠন, শ্রমিক নেতা, সুশীল সমাজ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সকল শক্তির সাথে নিয়মিত, প্রাতিষ্ঠানিক সংলাপের ব্যবস্থা করা। মাসিক অথবা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত এই ফোরাম হবে পারস্পরিক চিন্তা-ভাবনা ও ভাবের বিনিময় সহ বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎ রণকৌশল প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ।

রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সর্বোচ্চ মান উন্নয়নে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ প্রয়োজন। যা রাজনৈতিক দল হিসেবে বর্তমানে বিএনপির কাছে রয়েছে। দলের সংবিধানে বা অভ্যন্তরীণ নীতিমালায় ‘রাজনৈতিক শিষ্টাচার’-এর স্পষ্ট বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বৈধ নীতিগত সমালোচনা দলের নীতি ও কর্মসূচির মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে, ব্যক্তিগত আক্রমণ বা অশালীন ভাষার আশ্রয় নেয়া নয়। দলের সকল স্তরের নেতা-কর্মীদের জন্য এই শিষ্টাচার বাধ্যতামূলক করা এবং লঙ্ঘনের জন্য সুস্পষ্ট শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকতে হবে। এটিই হবে দলের পরিপক্কতার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

৩.

সুইং ভোটার ধরে রাখায় কৌশলী জাতীয়তাবাদী আদর্শের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ও সেই সাথে সকল জনগনের জন্য সম্মান ও মূল্যবোধ নিশ্চিত করা। বিএনপির জাতীয়তাবাদের আদর্শকে শুধু ধর্ম বা বর্ণের উর্ধ্বে নয়, বরং সকল আঞ্চলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণকারী একটি সামগ্রিক প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

সুইং ভোটারদের মন জয়ের কলাকৌশল জানা। যে সুইং ভোটাররা (বিশেষ করে শহরাঞ্চল ও অর্ধ-শহুরে এলাকায়) দলীয় আনুগত্যে না থেকে বরং কার্যক্ষমতা ও ভবিষ্যত দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ভোট দেন, তাদের টার্গেট করে বিশেষ প্রচারণা। তাদের চিন্তা, চেতনা, চাহিদা ও আশঙ্কা বুঝতে হলে ‘সোশ্যাল লিসেনিং’ ক্যাম্পেইন চালানো দরকার। তাদের সাথে সরাসরি সংলাপে বসে দেশের প্রধান সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করা।

অর্থনৈতিক ও সার্বভৌমত্বের বার্তা জাতীয়তাবাদের ধারণাকে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সাথে যুক্ত করে। তাই স্থানীয় শিল্প, কৃষি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগকে রক্ষা ও উৎসাহিত করার নীতি প্রনয়ন করা, যাতে দেশের সম্পদ দেশের মানুষের কাজে লাগে – এই বার্তাটি সুইং ভোটারসহ সাধারণ মানুষের কাছে জোরালোভাবে পৌঁছাতে হবে।

৪.

প্রতিপক্ষের সমর্থকদের পুনর্বাসনে নাগরিকত্বের রাজনীতিতে উত্তরণের মাধ্যম একটি বিশেষ পদ্ধতি। পতিত আওয়ামী লীগের সমর্থকদের একটি বড় ও উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে রয়েছেন, তাঁরা এদেশের নাগরিক এবং তাদেরকে দলীয় শত্রু হিসেবে না দেখে সাধারণ নাগরিক হিসেবে সম্মান ও আকর্ষণের চেষ্টা করা বিএনপির জন্য একটি ব্যতিক্রমী ও সম্ভাবনাময় কৌশল।

দল-নিরপেক্ষ বিভিন্ন নাগরিক উদ্যোগও এর মধ্যে শামিল। স্থানীয় পর্যায়ে (ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা) দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে নাগরিকদের সমস্যা (যানযটমুক্ত, পরিবেশ দূষণ, স্যানিটেশন, শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যসেবা) ইত্যাদি সমাধানের লক্ষ্যে ‘সিটিজেনস ফোরাম’ বা কমিটি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা। এসব ফোরামে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিএনপি নেতা-কর্মীরা স্থানীয় জনগণের কাছে একটি ভিন্ন, সেবামূলক ও গ্রহণযোগ্য চিত্র তুলে ধরতে পারবেন।

ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের আশ্বাস ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ত একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করতে হবে। বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার কারণে নিজস্ব নির্যাতিত, নিখোঁজ বা কারারুদ্ধ কর্মী-সমর্থকদের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি, দলীয় পরিচয় ছাড়াও নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক কারণে নির্যাতিত ব্যক্তি ও পরিবারের জন্য আইনি সহায়তা ও মানবিক সহযোগিতা প্রদানের একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলাও দলটিকে একটি ন্যায়নিষ্ঠ ও মানবিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

৫. 

যুব মস্তিষ্ককে সুসংহত করে বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী ট্রেন্ডিং বার্তা ব্যবস্থাপনার জন্য তৈরি করা। তরুণদের নেতৃত্ব ও উপদেষ্টা পরিষদ গঠন এবং একটি কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত ও সুসঙ্গত বার্তা প্রচারের ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিভিন্ন ধারণাকে একত্রিত করতে সংগঠন ব্যতিরেকে তরুন সমাজ বিজ্ঞানী, রাষ্ট্র চিন্তক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মাধ্যমে যুব উপদেষ্টা পরিষদ গঠন ও শক্তিশালীকরণ। শুধু আনুষ্ঠানিকতা হবে এমন যেন না হয়। দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সাথে প্রতিদিনের রাজনৈতিক ইস্যু, বক্তব্য ও এজেন্ডা নির্ধারণে সরাসরি সম্পৃক্ত একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী যুব উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করতে হবে। এই পরিষদ সমসাময়িক ঘটনাবলীর দ্রুত বিশ্লেষণ করে দলীয় অবস্থান ও বার্তা নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখবে।

সেই সাথে একক ও সুস্পষ্ট বার্তা প্রচারে সতর্কতা অবলম্বন করাও জরুরী। স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে দলের রাজনৈতিক কৌশল, এজেন্ডা ও বক্তব্যের একটি কেন্দ্রীয় ফ্রেমওয়ার্ক থাকতে হবে। এই ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যেই দলের সকল স্তরের নেতা-কর্মী ও মুখপাত্রদের বক্তব্য রাখতে হবে। ডিজিটাল প্লাটফর্ম যেমন (ফেসবুক, এক্স) হ্যান্ডেল ব্যবহার করে এই বার্তা দ্রুত ও কার্যকরভাবে সকল নেতাকর্মীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দলীয় মুখপাত্রদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও ব্রিফিং বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৬. 

এজেন্ডা বাস্তবায়নে দলীয় পদযাত্রার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করা। নিজেদের দলীয় নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিখোঁজ ও হত্যার শিকার কর্মী-সমর্থকদের পরিবারের কাছে পৌঁছানো এবং তাদের বেদনা ও দাবিকে দলের রাজনৈতিক এজেন্ডার কেন্দ্রে রাখা অত্যন্ত আবশ্যক।

দলীয় রাজনীতির জন্য উৎসর্গীত ও মৃত্যুবরণ করা সকল কর্মী সমর্থকদের নাম, এলাকার নাম, কৃতিত্ব ও প্রতিহিংসার স্বীকার হলে সেই সকল ঘটনাগুলোর মানচিত্র উদাহরণ হিসেবে সামনে রাখা।

দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় বিএনপির কতজন কর্মী-সমর্থক কোন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কার পরিবার নিখোঁজ বা হত্যার শিকার ব্যক্তির ন্যায়বিচারের জন্য হাহাকার করছে – তার একটি পূর্ণাঙ্গ ও হালনাগাদ ডাটাবেজ তৈরি করা। এটি শুধু তথ্যই নয়, এটিই হবে মানবিক সংযোগের একটি উল্লেখযোগ্য ভিত্তি।

মানবিক সংস্পর্শ ও প্রতিশ্রুতি প্রদানের মাধ্যমে ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু বড় সমাবেশ নয়, ছোট ছোট পদযাত্রা ও সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে সকল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছানো। তাদের কথা শোনা, তাদের দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নেওয়া এবং তাদের পাওনা ন্যায়বিচার আদায়ের জন্য দলের পূর্ণ শক্তি নিয়োগের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা। তাদের কষ্ট ও সংগ্রামকে দলের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে একাত্ম করা। এই সংস্পর্শই দলের প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থনকে আরও উজ্জীবিত করবে।

৭.

দলীয় অপরাধ নির্মূলে তরুণ ভিজিল্যান্স টিম বা স্বচ্ছতার অভিযান কার্যকর করা। দলীয় অভ্যন্তরে নেতা-কর্মীদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ ও দুর্নীতি দমনের জন্য একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ও তরুণ-নেতৃত্বাধীন তদন্ত ও নজরদারি ব্যবস্থা গঠন করা অতীব জরুরি।

উপজেলা ভিত্তিক রাজনৈতিক স্বচ্ছতার মানদন্ড নির্ণায়ক কমিটি তৈরি করা। প্রতিটি উপজেলায় সৎ, মেধাবী, নির্ভীক, দূরদর্শী এবং আইটি-সক্ষম তরুণদের নিয়ে গঠিত ‘ভিজিল্যান্স কমিটি’ গঠন করতে হবে। এই কমিটির দায়িত্ব হবে দলীয় নেতা-কর্মীদের দ্বারা সংঘটিত যে কোনো ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, জবরদখল, হয়রানি বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, প্রাথমিক তদন্ত এবং কেন্দ্রীয় দলীয় শৃঙ্খলা কমিটির কাছে প্রতিবেদন পেশ করা। সেই সাথে গোপন রিপোর্টিংয়ে মাধ্যমে তাঁদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তার জন্য (শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ছায়া কমিটি) থাকবে যারা উপজেলা ভিত্তিক কমিটির কাজের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করবে। অনিয়মের শিকার ব্যক্তি বা সাক্ষীদের জন্য গোপন রিপোর্টিং সিস্টেম (প্রযুক্তি সমৃদ্ধ হটলাইন, ইমেইল/অ্যাপ) ও সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রয়োজনে দলীয় তহবিল থেকে কমিটির সদস্যদের জন্য সম্মানী বা পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আর্থিক অনটনের কারণে কেউ দুর্নীতিতে জড়িয়ে না পড়েন। এই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দ্রুত ও কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

৮. 

দলীয় কোন্দলের কঠোর নিরসনের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক ঐক্যের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন। দৃশ্যমান দলীয় কোন্দল ও বিভক্তি বিএনপির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এটি সাধারণ সমর্থকদের মাঝে হতাশা সৃষ্টি করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থা নষ্ট করে দেয়।

দৃঢ়চিত্তে সামগ্রিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে দলীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলা বিনষ্টকারী, কোন্দল সৃষ্টিকারী এবং দলীয় সিদ্ধান্তের অবমাননাকারী যে কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দ্রুত, নির্মোহ ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। পদোন্নতি, দায়িত্ব বণ্টন বা নির্বাচনে টিকিট প্রদানের ক্ষেত্রে কোন্দল সৃষ্টিকারীদের বাদ দিয়ে মেধা, সততা ও দলীয় অবদানের ভিত্তিতে যোগ্য যুব নেতৃত্বকে এগিয়ে আনার নীতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

গুরুতর কোন্দলের ক্ষেত্রে দলীয় অভ্যন্তরীণ বা গ্রহণযোগ্য বাইরের ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে সংলাপ ও মধ্যস্থতার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে মধ্যস্থতায় ব্যর্থ হলে বা কোন্দল ইচ্ছাকৃতভাবে বৃদ্ধি ও দলের জন্য ক্ষতিকর হলে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থাকে চূড়ান্ত পথ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে উশৃংখল পক্ষকে শাস্তিমূলক বহিষ্কারের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন জায়গার জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যেতে পারে। তবে এই কঠোরতা দলের ভিতরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জায়গাটিকে সুরক্ষিত রাখবে।

৯.

প্রতিপক্ষের ন্যারেটিভ প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব গল্প বলার সাহস তৈরি করা একটি নতুনত্বের ধারণা।

বিএনপিকে অবশ্যই আওয়ামী লীগ বা অন্যান্য বিরোধী শক্তির ন্যারেটিভ বা বয়ানে আটকে না থেকে নিজস্ব ইতিবাচক, ভবিষ্যৎমুখী ও সমাধান-ভিত্তিক গল্প বলতে হবে। অনুকরণীয় চরিত্র বদলে নিজস্ব জাতীয়তাবাদের আদর্শের উপর ভিত্তি করে স্লোগান ও নিজেদের পরিচয় উপস্থাপন করলে এটিই হবে ইতিবাচক এজেন্ডার কেন্দ্রবিন্দু।

“অতীত কর্মকান্ডে রাজনৈতিক ভাবে দোষারোপ” বা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সমালোচনার চেয়ে বিএনপির নিজস্ব দেশ গড়ার পরিকল্পনা, বিশেষ করে যুব সমাজ, অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণ, সুশাসন ও জবাবদিহি, দুর্নীতি নির্মূলের অঙ্গীকার, পরিবেশ-জলবায়ু, ন্যায়বিচার ও মানবতা প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ক ভিশন ও  দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প উপস্থাপন করতে হবে।

বাঙ্গালী নয়! বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণাকে সংকীর্ণতায় না ফেলে বরং সকল নাগরিকের সম্মান, মর্যাদা ও উন্নয়নের নিশ্চয়তা প্রদানের মাধ্যমে একটি আবেগী ও ঐক্যবদ্ধকরণ বার্তা উপস্থাপন করা যেতে পারে। উদাহরণ হতে পারে “দেশের জন্য, সবাইকে নিয়ে” – এই ধরণের সার্বজনীন সৃষ্টি আবেগ ও প্রকৃত জাতীয়তাবাদের সুস্থ সংমিশ্রণ ঘটাবে।

আমি মনে করি, ব্যতিক্রম হওয়াই এখন মূল কৌশল হিসেবে বিবেচিত হবে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে টিকে থাকার জন্য। তবে মনে রাখতে হবে কাউকে প্রতিপক্ষ বানানো যাবেনা। সেই সাথে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপূর্ণ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে।

জুলাই অভ্যূত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে বিএনপির সামনে পথ স্পষ্ট কিন্তু বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিই এখন প্রধান বাঁধা। তাই প্রাসঙ্গিকতা না হারিয়ে ব্যতিক্রমী হওয়াই হবে যুক্তিসঙ্গত।  আলোচিত এই কৌশলগুলো শুধু জনপ্রিয়তা ফেরত পাওয়ার কৌশল নয়; এগুলো বিএনপির জন্য মৌলিক দুর্বলতাগুলো থেকে মুক্ত করে একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও জনবিচ্ছুরিত রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরের একমাত্র রূপরেখা। এটি একটি দীর্ঘ ও কঠিন পথ, যার জন্য প্রয়োজন নেতৃত্বের দৃঢ়তা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অভ্যন্তরীণ সংস্কারের সাহস এবং জনগণের প্রতি আন্তরিক প্রতিশ্রুতি।

পুরনো দলীয় সংস্কৃতির কবর রচনা করে তরুণ উদ্ভাবনী নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া, জুলাইয়ের গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে অটুট বন্ধন গড়ে তোলা, সুইং ভোটারদের আকর্ষণে অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদের পুনঃসংজ্ঞায়ন, প্রতিপক্ষের সমর্থকদের নাগরিক হিসেবে সম্মান ও আকর্ষণ, যুব মস্তিষ্কের মাধ্যমে সুসংহত বার্তা প্রচার, নির্যাতিতদের বেদনাকে দলের সংগ্রামের কেন্দ্রে স্থাপন, তরুণ ভিজিল্যান্সের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, দৃঢ় হাতে দলীয় কোন্দল দমন এবং নিজস্ব ইতিবাচক এজেন্ডা নিয়ে জনগণের সামনে উপস্থিত হওয়া – এই  স্তম্ভগুলোর উপরই দাঁড়াবে বিএনপির ব্যতিক্রম নতুনত্ব ও পুনর্জন্ম।

এই রূপান্তর কেবল বিএনপির জন্যই নয়, বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। বিএনপি যদি সত্যিকার অর্থেই “ব্যতিক্রম” হওয়ার সাহস দেখাতে পারে, তাহলে বিএনপি জনগণের কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক বিকল্প হিসেবে নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভীতকে আরও শক্তিশালী করবে। এখনই সময় সাহসী সিদ্ধান্তের, এখনই সময় ব্যতিক্রমী হওয়ার।

2 thoughts on “বিএনপি’র পুনর্গঠন রোডম্যাপ, নতুনত্ব ও রূপান্তর কৌশল;

  1. খুব সুন্দর ও গঠনমূলক তথ্য তুলে ধরার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আশা এমন আরোও লেখা আমাদের উপহার দিবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *