❝বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ❞

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইসলামী মূল্যবোধ ও আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো ঐতিহাসিকভাবে বিভক্ত ও বিভিন্ন ইস্যুতে মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সমবেত হওয়ার চেষ্টা করছে। এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন বলে মনে করছেন রক্ষণশীল সচেতন মুসলিম কমিউনিটি। এই ধারণা ও এই ঐক্যবদ্ধতা বাংলাদেশে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে, এই সম্ভাবনাকে ম্লান করতে বিএনপি ও বাম দলগুলোর বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করছে বলে অনেকের ধারণা, যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পথকে আরও প্রশস্ত করছে।

অন্যদিকে, বিএনপির চলমান রাজনৈতিক সংকট, দলীয় শৃঙ্খলার অভাব এবং কৌশলগত ভূল সিদ্ধান্ত ক্রমশ তাদেরকে দুর্বল করে তুলছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে, তবে এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত কৌশলগত পরিকল্পনা ও জনসমর্থন।

ইসলামী দলগুলোর ঐক্য একটি নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনা। কারণ, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ইসলামী আদর্শের দলগুলো তাদের মধ্যকার মতপার্থক্যকে পাশ কাটিয়ে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের অভিপ্রায়, কারণ অতীতে ইসলামী দলগুলো বিভিন্ন ফ্রন্টে বিভক্ত ছিল। তবে এই ঐক্যের পেছনের কারণগুলোর ধারণা এমন হতে পারে-

✪ বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা থেকে সামষ্টিক ইসলামী মূল্যবোধকে শক্তিশালী করার জন্য জোটের দিকে প্রত্যাবর্তন একটি বড় কারণ হতে পারে। সেই সাথে ইসলামী দলগুলোও উপলব্ধি করেছে যে, বিভেদের কারণে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক বলয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, যেটি সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল অন্তরায়। তাই, একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম গঠন করে তারা রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করছে।

✪ গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের সুযোগ হিসেবে দেখলে, দেখা যায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ (নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল) এর বাইরে একটি বিকল্প শক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। যেটি ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। ইসলামী দলগুলো এই শূন্যতা পূরণে সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হচ্ছে। এটি ইতিবাচক ভূমিকার পথ প্রশস্ত করছে।

✪ ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ইসলামী আদর্শের মূল ভিত্তি হলো ইনসাফ। যেটি শরিয়া আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব বলে মনে করেন ইসলামী দলগুলোর নেতারা। যেহেতু এদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটে সাধারণ মানুষ একটি ন্যায়পরায়ণ শাসনব্যবস্থা কামনা করে, সেহেতু ইসলামী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধতা ও সম্মিলিত জোট গঠন দলগুলোর জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে।

অপরদীকে, ইসলামী দলগুলোর এই ঐক্যবদ্ধতা বাম ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শিবিরের জন্য হুমকিস্বরূপ। যে কারনে, বিএনপি ও অন্যান্য বাম দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া বিভেদ সৃষ্টির কৌশল হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। তারাও রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিভিন্নভাবে এই জোটকে দুর্বল করার চেষ্টাও করছে বলে অনেকে মনে করেন। তাদের কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে—
ইসলামী দলগুলোর ঐক্যকে ‘অগণতান্ত্রিক’ ও ‘মৌলবাদী’ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। ইসলামী দলগুলোর মধ্যে অতীতের মতবিরোধ ও দ্বন্দ্বকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে, যাতে তাদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়। কিছু গোষ্ঠী রাজনৈতিক সহিংসতার মাধ্যমে পরিস্থিতিকে নেতিবাচক ও অস্থিতিশীল করে তুলতে চায়, যাতে ইসলামী জোটের সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত হয়।
জামায়াতে ইসলামীর এক কর্মীর বক্তব্য অনুযায়ী, বিএনপি ও বামপন্থী দলগুলো প্রকাশ্যে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করছে। তাদের লক্ষ্য হলো ইসলামী দলগুলোর জোট গঠন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা।

ইসলামী দলগুলোর জোটের সম্ভবনার বিপরীতে বিএনপির রাজনৈতিক সংকট ও কৌশলগত ভুলঃ
বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতেতে কোন না কোনভাবে বিএনপির নাম চলেই আসে। তবে বিগত ষোল বছরে বিএনপির ওপর জেল-জুলুম নির্যাতন, মামলা-হামলা, গুম ইত্যাদির কারণে সাধারণ জনগনের যে সহানূভূতি তৈরি হয়েছিল তা এত দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে তা কেউ কল্পনা করতে পারেনি। এই কারণে গণঅভ্যুত্থানের পরে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন। তবে তাদের কৌশলগত ভুলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
অভ্যুথানের সময়ে জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন “আমরা এই আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িত নই, আমরা এই আন্দোলনকে নৈতিক ভাবে সমর্থন দিয়েছি” এই বক্তব্যটি একটি বড় ভূল ছিল। যেটি স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাবকেও প্রকাশ করে।

বিএনপি ছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া সকল দলের এক জায়গায় ঐক্য রয়েছে সেটি হলো “শুধুমাত্র ক্ষমতার পালা বদলের জন্য জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়নি” কিন্তু বিএনপি’র সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোতে এই বিষয়ে অনৈক্য প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাঁরা বিভিন্নভাবে বলে আসছেন, সংস্কারের মূল স্টেকহোল্ডার নির্বাচিত সরকার, অনির্বাচিত সরকারের দ্বায়িত্ব শুধু মৌলিক সংস্কার করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। এটিও তাঁদের কৌশলগত দুর্বলতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপরিপক্কতার ও জনসমর্থন হারানোর কারন হতে পারে।


অপরদীকে, গণঅভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিকে বিএনপি প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা যা তাদের জন্য একটি বড় ভুল। এতে করে তারা সম্ভাব্য মিত্রদেরও নিজেদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে। এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হতে পারে রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। এখন এই দুই দল একে অপরের মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে রাজনৈতিক মাঠে দন্ডায়মান। আজই এনসিপির জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসেবে চট্টগ্রামের চকরিয়ায় নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারীর বক্তব্য ঘিরে বিএনপির সমর্থিত নেতা কর্মীদের সমাবেশস্থলে হামলা ও ভাঙ্চুর পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে দিতে পারে।


আরেকদিকে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার ছিল প্রবাসী সাংবাদিকবৃন্দ। তাঁদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মানে, রাষ্ট্র সংস্কারে তাঁদের অংশগ্রহণ ও মতামতের গুরুত্বকে নিশ্চিত করতে না পারাও বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির বড় ব্যার্থতা। কারণ বিগত সময়গুলোতে বিএনপির প্রতি শেখ হাসিনা সরকারে অন্যায্য হামলা-মামলা বিষয়ে জনগনের হৃদয়ে জনসমর্থন তারাই জুগিয়েছিল। কিন্ত দেখা যাচ্ছে, আলোচিত ও সমালোচিত এক্টিভিষ্ট পিনাকী ভট্টাচার্য, সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইন সহ অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়ানো ও অভিযোগ তোলা বিএনপি’র দলীয় নেতা কর্মীদের কৌশলগত আরেকটি ভূল।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের কারণে অনেক ঘটনা যেমন, জুলাই অভ্যূত্থান পরবর্তী দশ মাসে বিএনপির দলীয় কোন্দলে একশত পঞ্চাশ জন খুন হওয়া সহ বিএনপি’র সংকটগুলো এখন সবার সামনে প্রকাশিত হচ্ছে। বর্তমানে বিএনপির সমর্থন শুধুমাত্র তাদের দলীয় কর্মী ও কিছু সুবিধাভোগীর মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন অনেকেই। সেই সাথে সচেতন নাগরিকদের একটি বড় অংশ তাদের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো— বিএনপির কিছু নেতা-কর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। বিএনপি বারবার ভুল কৌশল গ্রহণ করে জনমতকে নিজেদের বিপক্ষে নিয়ে যাচ্ছে। বিকল্প রাজনৈতিক ধারা হিসেবে বিএনপি জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন উপস্থাপন করতে পারছে না। ফলে, আগামী দিনে বিএনপি যদি তাদের কৌশল ও নেতৃত্বে আমূল পরিবর্তন না আনতে পারে, তবে তাদের রাজনৈতিক প্রাসাদ ধ্বসে পড়তে পারে।

ইসলামী দলগুলোর সম্ভাবনা ও করণীয়;
ইসলামী দলগুলো যদি তাদের ঐক্যবদ্ধতা বজায় রাখে এবং কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে— সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে এবং তা অবশ্যই জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুসরণের মাধমেই হতে হবে। সামষ্টিক উন্নয়ন ও ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি হতে হবে বাস্তবসম্মত। কল্যাণ রাষ্ট্র বির্নিমানে ইসলামী দলগুলোকে মৌলিক বিষয়াবলীর সংস্কারের সূদুরপ্রসারী ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে দুর্নীতি নির্মূল, অসাম্য ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের গাইড লাইন নিয়ে কাজ করতে হবে এবং নিশ্চয়তা প্রদাণ করতে হবে।


অনেকেই মনে করছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ইসলামী আদর্শের দলগুলোর ঐক্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। তবে, এই ঐক্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাদেরকে বাম ও জাতীয়তাবাদী দলগুলোর বিভেদ সৃষ্টির কৌশল মোকাবেলা করতে হবে। অন্যদিকে, বিএনপির মতো দলগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট সমাধান করে জনসমর্থন ফিরে পেতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসলামী দলগুলোর সঠিক নেতৃত্ব ও কৌশল বাংলাদেশে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে, এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সহনশীলতা এবং জনগণের সাথে গভীর সংযোগ স্থাপন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *