জীবন বাজি রেখেছিল জুলাই আন্দোলনে নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা।

কলেজের বাংলা বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবদুন নুর বলেন, কোটা আন্দোলনের কথা আমি সর্বপ্রথম শুনেছি ২০১৮ সালে। তখন অতটা বুঝতাম না,২০২৪ সালে এসে আজ আবারো সাধারণ শিক্ষার্থীরা ন্যায্যতার ভিত্তিতে কোটা প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য মাঠে নেমেছে । কবি নজরুল কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ৮ জুলাই লক্ষ্মীবাজার ব্লক ও বিক্ষোভ মিছিলে সেদিন সর্বপ্রথম ব্যানার ধরে আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে দাঁড়ানোর সৌভাগ্য আমার হয়।

২৪-এর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অধিকার আদায়ের এই লড়াইয়ে পিছিয়ে ছিল না রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরাও। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে জীবন উৎসর্গ করেছে কলেজের সাহসী চার শিক্ষার্থী এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির হাজারো শিক্ষার্থী।

তিনি আরও বলেন, ১৯ তারিখ শুক্রবার লক্ষীবাজারে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল হবে। ছোট ভাই ইউসুফ এবং বন্ধু মনিরের সাথে গিয়ে একত্রিত হলাম। ভিক্টোরিয়া পার্কের এক প্রান্তে ছাত্রলীগ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট সহ অপর প্রান্তে পুলিশ। আমরা ভিক্টোরিয়া পার্কের মসজিদের এই প্রান্ত থেকে আগাবো এমনই মুহূর্তে গুলি শুরু করল পুলিশ এবং অপরপ্রান্তে ছাত্রলীগ। উপায় না পেয়ে পিছাতে লাগলাম আমরা, হঠাৎ আমাদের মধ্যখানে মসজিদের ছাদ থেকে উড়ে এসে পড়ল টিয়ারশেল। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখ মুখ দম বন্ধ হয়ে, পৃথিবী জুড়ে অন্ধকার নেমে আসলো। সহপাঠীরা রসের গলিতে নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তাপ দেওয়ার পরে স্বাভাবিক অনুভব করলাম। সেদিন জুম্মার নামাজের পরে লক্ষীবাজারের নেমে এসেছিল এক যুদ্ধের ময়দান। চোখের পলকে শেষ হয়ে গেল আমাদের চার সহযোদ্ধা। লক্ষীবাজারের রসের গলিতে পড়ে রইল একসহযুদ্ধার টগবগে মগজ। সেদিন শহীদ হতে না পেরে নিজেকে খুব অসহায় ও ব্যর্থ মনে হয়েছিল।

৮ জুলাইয়ের আগের রাতে আমি, নীর, রাজিব মিলে ক্যালেন্ডার, আর্ট পেপারে কোটা বিরোধী স্লোগান লিখি। বন্ধু মনিরুজ্জামান মারুফকেও একই কাজ করতে বলি। ৮ জুলাই আমরা কবি নজরুল কলেজ হতে এককভাবে কলেজের বিপরীত পাশে পেট্রোল পাম্পের ঐখানে ঘণ্টা দুয়েক এর মতো ব্লক করে স্লোগান দেয়। ১০ জুলাই কবি নজরুল, সোহরাওয়ার্দী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় মিলে গুলিস্থান জিরো পয়েন্ট অবরোধ করি। সেদিন আমি একটি কবিতা আবৃতি করি কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে।

তিনি বলেন, ১৫ তারিখ আমরা তিন প্রতিষ্ঠান একত্রিত হয়ে ঢাবিতে যাওয়ার পথেই শাহবাগে পুলিশ আমাদের থামানোর জন্য রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে লাঠি দিয়ে পায়ে পিটিয়েছিল। আমিও পায়ে আঘাত পায়, ব্যথা নিয়েই টিএসসি যাই৷ টিএসসি গিয়ে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকি। একপর্যায়ে ঢাবির হলগুলো থেকে ছাত্রলীগ ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে আমাদের দিকে লক্ষ্য করে। এরপর হলের গেইটগুলো ভেঙে ছাত্রলীগ হল থেকে বের হয়ে আমাদের নৃশংসভাবে আক্রমণ করে।ঐ যাত্রায় বেঁচে গেলেও সকলের সাথে দৌড়ে ঢাবি থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসি তখনই আবার হামলা করে ছাত্রলীগ নিক্ষেপ করে ইট-পাটকেল। তখন লীগের কর্মীরা যাকে পাচ্ছিল তাকেই মারছিল। শেষমেশ বিজয় একাত্তর হলে কিছু মা-বোনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সেখান থেকে নিরাপদে বের হই।

কবি নজরুল কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মাহমুদ হাসান বলেন, ২৪-এর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আমি ও আমার বড় ভাই একসাথে আন্দোলনে নেমেছিলাম। আন্দোলনে মিছিলে আমার চোখের সামনেই গুলিবিদ্ধ হন ভাই। তার শরীরে ঢুকে যায় সিসার তিনটি গুলি। পরে হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দুটি গুলি বের করা সম্ভব হলেও, একটি এখনো তার বাহুতে।

একের পর এক পুলিশের গুলিতে ঝরে পড়ছিল নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা, প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক একটি দীর্ঘ দিনের মতো। পুলিশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল হেলমেট বাহিনী তথাকথিত নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও। তার এক সঙ্গে আক্রমণ করেছিল নির্মমভাবে। আন্দোলনের সময় আমার একেবারে চোখের সামনেই পুলিশের গুলিতে পাঁচজন শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ দৃশ্য যেন এখনও চোখে ভাসে।

মাহমুদ হাসান আরও বলেন,আন্দোলনের দিনে আমার পাশেই একজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। সেদিন আমার সম্মুখেই পড়েছিল একটি টিয়ারশেল, সেই মুহূর্তটা ছিল অনেক বেশি যন্ত্রণার। নাক-মুখ যেন পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল এরকম এক অনুভূতি হচ্ছিল। সেই অভিজ্ঞতার পর একাধারে আট দিন তীব্র জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা নিয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *