গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হয়ে উঠেছে ‘জুলাই সনদ’ ও ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। রাজনৈতিক নেতা ও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখে একই সময় এ দুটি শব্দ শুনে অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যান। সনদ ও ঘোষণাপত্র জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে হলেও এ দুটির মধ্যে সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে। সরকারের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে বলেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ একেবারেই আলাদা বিষয়।
জুলাই সনদ তৈরির লক্ষ্যে এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তারা একটি খসড়াও তৈরি করেছে। চূড়ান্ত হলে যেটিতে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করবে। অপরদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হবে আগামী ৫ আগস্ট বিকেল ৫টায়।
জুলাই সনদ কী
এক কথায় বললে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ হলো মৌলিক সংস্কার সংশ্লিষ্ট দলিল। অভ্যুত্থানের পর সরকার পরিচালনা কাঠামো থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি ওঠে। এ জন্য সংবিধান থেকে শুরু করে পুলিশ বাহিনী পর্যন্ত সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন গঠন করে সরকার। এসব কমিশন এরই মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এসব সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য দরকার রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত। এ কারণে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। যেটির কাজ বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ওপর রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ, দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা। প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত হলেই তা একটি সনদ বা চার্টার আকারে প্রকাশ করা হবে। অর্থ্যাৎ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাবের চূড়ান্ত রূপই হবে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ। এই সনদে বলা থাকবে, কী কী সংস্কার কীভাবে হবে।
গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জুলাই সনদ কী তা নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে’কটিতে একমত হয়েছে, তার তালিকা থাকবে এই সনদে।’
মোট কথা জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ হলো, গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কার করার একটি রূপরেখা বা রোডম্যাপ। এবং এটি রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা স্বীকৃত।
জুলাই সনদ কীভাবে কাজ করবে
এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কয়েক দফায় বৈঠক করেছে। যেটি শেষ হয়েছে গত ৩১ জুলাই। শিগগিরই রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া দেওয়ার কথা রয়েছে। এতে থাকবে কোন সিদ্ধান্তে দলগুলো ঐকমত্য হয়েছে এবং কোনগুলোতে আপত্তিসহ একমত হয়েছে।
সনদ চূড়ান্ত হলে তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকারসহ স্বাক্ষর করার কথা রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর। খসড়ায় ৭ দফা অঙ্গীকার রয়েছে। দ্বিতীয় দফায় সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সংস্কারে যেসব সুপারিশে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার রয়েছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, এর জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিমার্জন, পুনর্লিখন এবং আইন, বিধিবিধানেও অনুরূপ পরিবর্তন করা হবে। আগামী সংসদ নির্বাচনে গঠিত সরকার তা দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে।
জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে গত শুক্রবার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। চট্টগ্রামে তিনি সাংবাদিকদের বলছেন, জুলাই সনদের সুপারিশগুলো দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতিবন্ধ। এ ছাড়া, এটি বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান, আইন ও বিধিবিধানের যেসব সংশোধনী প্রয়োজন সেগুলো করতেও তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ঘোষণাপত্র কী
গণঅভ্যুত্থানের পর গত ৩১ ডিসেম্বর আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সরকারিভাবে ঘোষণাপত্র প্রকাশের কথা বলা হয়েছে। ঘোষণাপত্র কী তা নিয়ে গত ৩০ জুন ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে পোস্ট দেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, জুলাই ঘোষণাপত্র হচ্ছে জুলাইয়ে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, শহীদ, আহত ও নেতৃত্বদের অবদান এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষার একটি জাতীয় দলিল। পরবর্তীতে যা আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি পাবে।
এনসিপির প্রচার ও প্রকাশনা সেলের সদস্য খালেদ সাইফুল্লাহ জুয়েল রোববার বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র হলো গণঅভ্যুত্থান ও পরবর্তীতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক ধরনের স্বীকৃতি। এর আইনি ভিত্তি থাকবে। যাতে পরে কেউ গণঅভ্যুত্থান ও সরকারকে ভিত্তিহীন দাবি করতে না পারে।
ঘোষণাপত্রে কী আছে
ঘোষণাপত্রের সবশেষ খসড়ায় ২৬টি দফা উল্লেখ আছে। সর্বশেষ খসড়ায় যোগ হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছাত্রছাত্রীর ওপর ছাত্রলীগ ‘পাশবিক নির্যাতন’ চালায়। ফলে শিক্ষার্থীরা ৯ দফা ঘোষণা করে, যা পরবর্তীতে এক দফায় রূপান্তরিত হয়। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন করেন।
সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর মন্ত্রিসভা, স্পিকার ও এমপিরা পালিয়ে যান। জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট। এ ছাড়া, সংবিধানের প্রস্তাবনায় জুলাই ঘোষণার উল্লেখ এবং তপশিলে যুক্ত করার কথা উল্লেখ আছে।