ভূমি নিবন্ধনে উৎস কর কমানোর দাবি সরকারের, কিন্তু হিসাবে চমক: প্রতি কাঠায় কর বেড়েছে ১৪৭%!

গত ২৪/০৬/২০২৫ তারিখে অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত গেজেট পর্যালোচনা করে জানা যায় ভূমি নিবন্ধনে পূর্বের গেজেট এর পরিবর্তে নতুন গেজেট প্রকাশ করা হয়। নতুন গেজেটে দেখা যায় প্রতি শতক ভূমি নিবন্ধনে উৎসঃ কর ৩০,০০০ টাকা বা ৩% হারে আদায় করার কথা বলা হয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত বছরের তুলনায় ভূমি নিবন্ধনের উৎস কর কমানোর দাবি করলেও বাস্তব হিসাব বলছে ভিন্ন কথা। গত বছর প্রতি কাঠায় (১.৬৫ শতকে) ২০,০০০ টাকা বা জমির মূল্যের ৬% (যেটি বেশি হয়) সেটি উৎস কর দেওয়ার নিয়ম থাকলেও নতুন গেজেটে বলা হচ্ছে প্রতি শতকে ৩০,০০০ টাকা বা ৩% (যেটি বেশি হয়)। সংখ্যায় মনে হচ্ছে হার কমেছে, কিন্তু হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে প্রতি কাঠায় কর বেড়েছ প্রায় ১৪৭%!

এটির গাণিতিক বিশ্লেষণ: কর কমল নাকি বাড়ল? পুরোনো নিয়মে (২০২৩-২৪) অর্থ বছরে প্রতি কাঠায় (১.৬৫ শতকে) ২০,০০০ টাকা অথবা মূল্যের ৬% (যেটি বেশি হয়)। উদাহরণ, যদি জমির মূল্য প্রতি শতক ১ লাখ টাকা হয়, তাহলে ১.৬৫ শতকের কর: ২০,০০০ টাকা বনাম (১.৬৫x১,০০,০০০x৬%) = ৯,৯০০ টাকা। অর্থাৎ এখানে ২০,০০০ টাকা দিতে হবে (কারণ এটি বেশি)।
অপরদীকে, নতুন নিয়ম (২০২৪-২৫) অর্থ বছরে প্রতি শতকে ৩০,০০০ টাকা অথবা মূল্যের ৩% (যেটি বেশি হয়) একই উদাহরণে (প্রতি শতক ১ লাখ টাকা হলে): ১.৬৫ শতকের কর= ১.৬৫x৩০,০০০ = ৪৯,৫০০ টাকা বনাম (১.৬৫x১,০০,০০০x৩%) =৪৯৫০ টাকা। অর্থাৎ এখানে ৪৯,৫০০ টাকা দিতে হবে (যা আগের তুলনায় প্রায় ১৪৭% বেশি)!

বিশিষ্ট লেখক ও সামাজিক সংগঠক এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর আজীবন সদস্য সমন্বয়ক মোঃ কাওসার আহম্মেদ একটি হিসাব তূলে ধরেন, ঢাকা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রায়তন্ত্রী মৌজার ৬.৫ শতক জমির সরকারী নিধারিত মূল্য ৪,৪৮,০০০/- টাকা (অর্থাৎ প্রতি শতকের ৬৮,৯২৩ টাকা) সে হিসেবে পুরোনো পদ্ধতিতে কর:
প্রতি কাঠায় ২০,০০০ টাকা * (৬.৫x১.৬৫) = ৭৮৭৭৮ টাকা।
নতুন পদ্ধতিতে কর:
প্রতি শতকে ৩০,০০০x৬.৫ =১,৯৫,০০০ টাকা (প্রায় ২.৫ গুণ বেশি)।
অপরদীকে, ফ্লাট নিবন্ধনের বিষয়ে জানা যায় পূর্বে যেখানে বর্গমিটারে উৎস কর আদায় করতে হতো সেটি এখন বর্গফুটে আদায় করার নির্দেশনা এই গেজেটে দেয়া হয়েছে।
কাওসার আহম্মেদ, আরও জানান তিনি প্রায় ৬ জন সাব-রেজিষ্ট্রার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এর সাথে কথা বলে আরও জানতে পারেন যে, এই বিষয়ে কোন সাব-রেজিষ্ট্রার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কারো সাথে কোন আলোচনা না করেই অর্থ মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি অর্থ উপদেষ্টার কাছে জানতে চান, কিভাবে তিনি অর্থ উপদেষ্টা হলেন যদি এই হিসেব না বোঝেন? কিভাবে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধন অফিসারদের মতামত উপেক্ষা করে এই গণবিরোধী গেজেট মঞ্জুর করলেন?
প্রকৃতপক্ষে, সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে ভূমি নিবন্ধনে কর বাড়িয়েছে কিন্তু সেটি সীমা অতিক্রম করেছে। কারণ রেজিষ্ট্রেশন খরচের পরিমান যদি হিসেব করা হয় তবে ১ শতক জমির মূল্য যেখানে ১ লক্ষ টাকা হয় সেই হিসেবে নিবন্ধনে সর্বমোট ৩৫% রেজিষ্ট্রেশন খরচ দিতে হবে।
এতে সাধারণ মানুষের উপর ক্রমাগত চাপ বাড়বে, এটি জন সাধারণের জন্য নতুন আর্থিক সংকট তৈরি করবে। সেই সাথে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ ভূমি নিবন্ধন থেকে বিরত থাকবে এবং সরকারও কাঙ্খিত কর হারাবে।
প্রশ্ন তৈরি হয়েছে কেন ভৌতিকভাবে এই উৎস কর বাড়ানো হলো? সরকারি মূল্য ও বাজারমূল্যের পার্থক্যের বিষয়ে আদৌ কি কোন
সমন্বয় হয়েছে? নতুন গেজেটে উৎস কর “কমানো”র নামে প্রকৃতপক্ষে তা বাড়ানো হয়েছে যেটা অযৌক্তিক। সরকারের উচিত স্বচ্ছ নীতি প্রণয়নে এবং স্থানীয় পর্যায়ের মতামত বিবেচনা করে এই উৎসে আয়কর নীতিমালা দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিবর্তন করা নইলে ভূমি নিবন্ধন প্রক্রিয়া জনবিরোধী হয়ে উঠবে, যা অর্থনীতির জন্য মারাক্তক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *