পুরান ঢাকার মিটফোর্ডে পাথর ছুঁড়ে বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জড়িতদের নাম সুকৌশলে পরিবর্তন করে জড়িত নয় এমন ব্যক্তির নাম যুক্ত করার অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা।
নিহত সোহাগের স্বজনদের অভিযোগ, মামলা দায়েরের আগে লেখা একটি অভিযোগপত্র পুলিশ তাদের পড়ে দেখার সুযোগ করে দিলেও পরবর্তীতে এজাহারের জন্য যে অভিযোগপত্রে পুলিশ বাদীর স্বাক্ষর নিয়েছে, তাতে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত তিনজন আসামির নাম কৌশলে বাদ দেয়ার পাশাপাশি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় এমন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
কিন্তু এই অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশ দাবি করেছে, এজাহার পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই। বাদী মামলার জন্য যে অভিযোগ দিয়েছেন, পুলিশ সেটিকেই এজাহার হিসেবে গ্রহণ করেছে।
নিহত সোহাগের স্বজনরা মামলার এজাহারের জন্য লেখা দু’টি অভিযোগপত্রের কপি সময় সংবাদকে দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি কপিতে ১৭ নম্বর আসামির হিসেবে আঃ লতিফ মোল্লার ছেলে কাইউম মোল্লা (৪৫), ১৮ নম্বর আসামি হিসেবে হাবিবুর রহমান হবির ছেলে রাকেশ (৩৫) এবং ১৯ নম্বর আসামি হিসেবে রহিম (৩৬) এর নাম উল্লেখ করা আছে। কিন্তু পুলিশ মামলার এজাহার হিসেবে যে অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করেছে, তাতে এই তিনজনের কারও নাম নেই। এছাড়াও মামলার এজাহারের ১৯ নম্বর আসামি জাফর আলী হাওলাদারের ছেলে আনিচুর রহমান হাওলাদারের (৪০) নাম উল্লেখ আছে। কিন্তু আনিচুর রহমান হাওলাদারের নাম মামলার এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার আগে নিহতের স্বজনদের পড়ে দেখার জন্য যে অভিযোগপত্রটি দেয়া হয়েছিল, তাতে উল্লেখ ছিল না।
নিহতের ভাগ্নী বিথী আক্তার বলেন, যখন পুলিশ মামলা লেখে তখন ঠিকঠাক মতোই লেখেন। তখন ১৭, ১৮, ১৯ – এই তিনজন আসামি নাম ঠিক ছিল। ওইখানের ওসি মনিরুজ্জামান মনির আমাকে মামলার কপিটি পড়তে বলেন। আমাকে একটি কলম দিয়ে তিনি বলেন, সংশোধনের কোন প্রয়োজন হলে তুমি নিজে থেকে সেটা এখানে লিখবে, তারপর আমরা সেটা সংশোধন করব।
বিথি আরও বলেন, ‘আমি তখন চালাকি করে ওই কপিটির একটি ছবি ফোনে তুলে রাখি। এরপর আমি ওই কপিটি পড়ি। এরপর আমি প্রশ্ন করি – যখন আমার মামাকে মারা হয়েছে, তখনতো অস্ত্র ছিল প্রত্যেকের হাতে এবং অস্ত্র দিয়েও আমার মামাকে আঘাত করা হয়ে, সেটা কেন লিখলেন না আপনারা? তখন ওসি বলেন, এটা আমরা সংশোধন করবো। কিন্তু ওনারা আগেই এটা সংশোধন করে রাখছিল ওনাদের নিজেদের মতো করে। আমার মা প্রথম যে কপিটা ছিল, ওইটায় তার সিগনেচার দিতে হতো, যেহেতু বাদী সে। কিন্তু সিগনেচার ওইটায় না নিয়ে তারা নিজেদের মতো যেটা সাজানো হয়েছে, তিনটা আসামি ১৭, ১৮, ১৯ নম্বর আসামিদের নাম বাদ দিয়ে দ্বিতীয়বার যেটা রেডি করা হয়েছে, তিনটা আসামির নাম কেটে দেয়া হয়েছে। এবং অন্য যারা এটার সাথে জড়িত নয়, তাদের নাম জড়ানো হয়েছে।
ওইখানে আমার মা না বুঝে সিগনেচারটা করে। এবং যারা মূল হোতা, মূল আসামি – যারা এ ঘটনার সম্পৃক্ত আছে সরাসরি, তাদের না দিয়ে যারা জানেই না কিছু, তাদের দেয়া হয়েছে। এবং মামলাটিকে কৌশলে অনেক হালকা করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রথমে পুলিশ মামলা নিতে চাচ্ছিল না। ঘটনার দিবাগত ভোররাত ৪টার দিকে টাইপিং করা হয়েছে। পরের দিন বৃহস্পতিবার দুপুরে সাড়ে এগারোটার সময় কপিটা আমাকে পড়তে দেয়া হয়। আমি সাড়ে এগারোটার সময় আমার ফোনে অভিযোগপত্রের ছবি তুলি।
‘অভিযোগপত্রের ছবি তোলার পর তারা এক ঘণ্টা সময় নেয়। ওনারা আমাদের সবাইকে বের করে দিছে, আমার মা (বাদী) কে একলা রাখছে তাদের রুমে, ওসি সাহেব যে মনিরুজ্জামান মনির ওনার রুমে। ওনার রুমে আরেকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিল। ওনারা আমার মাকে কি বলছে জানি না। আমার মা তো ভাবছে, প্রথম মতো আমি ওইটা চেক করছি, আমার ওপর ভরসা তার, আমিও তো ঠিকঠাক মতো চেক করছি, কিন্তু ওনারা কিছুই সংশোধন করেনি, বরং তারা নিজেদের মতো বক্তব্য দিয়ে আমার মায়ের হাত থেকে সিগনেচার রাখছে।’
এ বিষয়ে নিহতের বোন ও সোহাগ হত্যা মামলার বাদী মঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ‘ভাই মারা যাওয়ার কারণে আমার হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। আমি কপিটি আমার মেয়েকে দেখিয়েছি। আমি যখন সই করেছি, তখন মনে করেছি, আসামির নাম আছে। কিন্তু পরে দেখা গেল যে, না – আসামির নাম নাই। এখানে একটা পলিটিক্স করা হয়েছে। ওখানে যারা প্রকৃত দোষী, তিনজনের নামই বাদ দেয়া হয়েছে। যারা এই হত্যাকান্ডের মুল হোতা, ওরাই বাদ পড়ছে। আমার মেয়ে যে কাগজটা দেখেছে, ওটায় স্বাক্ষর নেয়নি। নিয়েছে অন্য আরেকটি কাগজে স্বাক্ষর। আমি তো এটা বুঝতে পারিনি। এটা নিয়ে তাঁরা (পুলিশ) এমন ছলচাতুরী করবে, তা বুঝতে পারিনি। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর আমরা পুলিশের সাথে ফোনে কথা বলেছি। এরপর কোতোয়ালি থানায় গিয়ে সরাসরি কথা বলে এসেছি। এখানে নির্দোষী লোক আছে, আর দোষী যারা তাদের নাম নাই। তাঁরা জানিয়েছে এটা ঠিক করে দেবে, আমাকে আশ্বাস দিয়েছে তারা (পুলিশ)। মামলার এজাহারও লিখেছে তারাই (পুলিশ)।
উল্লেখ্য যে হত্যাকান্ডের দুইদিন পর ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।
এ বিষয়ে ঢাকার কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘এজাহারতো তারা দিয়েছে, এজাহার কি আমরা করছি? এজাহার চেঞ্জ করার কোন সুযোগই নেই। তারা যেটা এজাহার দিয়েছে, আমরা সেটাই মামলা রেকর্ড করেছি। তারা কি অশিক্ষিত? তারা কি মূর্খ? আন্দাজে একটা কথা বলে। তারা শিক্ষিত, তারা ১০ জন, ২০ জন আসে একসাথে দেখতে। এখন এটা বললে হবে? এমনতো নয় যে, তারা অশিক্ষিত মানুষ, পড়েনি, দেখেনি। তারা পড়ছে, দেখছে, সব জেনেশুনে তাদের বক্তব্য মতো সেটা এজাহার করা করছে। এখানে আমাদের কিছু বলার নাই। আর আমরা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দেখে সমস্ত আসামি শনাক্ত করছি, ধরার চেষ্টা করছি।’
শনিবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার জসীম উদ্দিন বলেন, এখন পর্যন্ত চাঁদাবাজির কোনো বিষয় আমাদের জানা নাই। আমরা শুধু জেনেছি, এটা পারস্পরিক একটা দ্বন্দ্বের বিষয়। এই ব্যবসাটা (ভাঙারির ব্যবসা) তারা কিছুদিন একসঙ্গে করেছে। কিন্তু এক পর্যায়ে ব্যবসার লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকান্ডটি ঘটেছে।
ঐদিন সকালে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফিংয়ে মহাপরিচালক এ. কে. এম শহিদুর রহমান বলেন, সোহাগ হত্যাকান্ডে ছায়া তদন্ত করছে র্যাব। এছাড়া মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।